একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রচনা ২০২৫

একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলার দামাল ছেলেরা নিজের মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছিল। সেই আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ একুশে ফেব্রুয়ারিকে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ২০২৫ সালে আমরা আবারও এই মহান দিবসটি উদযাপন করবো, যা আমাদের ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার প্রতিশ্রুতির প্রতীক।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস
বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর, যখন পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা বাঙালিদের মাতৃভাষা বাংলার অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ ছিল। এর বিরুদ্ধে বাংলাভাষী জনগণ আন্দোলন শুরু করে এবং ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্রসমাজ ঢাকার রাজপথে নেমে আসে। পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ নাম না জানা আরও অনেকে। এই আত্মত্যাগের ফলেই ১৯৫৬ সালে বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ভাষার চেতনা স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ঘোষণা
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাবে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মাতৃভাষার গুরুত্ব ও সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এই দিনটি পালন করে আসছে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭০০০ ভাষার অস্তিত্ব থাকলেও প্রতি বছর অনেক ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এই দিবসটি ভাষাগত বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
একুশে ফেব্রুয়ারি ২০২৫: উদযাপন ও কার্যক্রম
২০২৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আরও বৃহৎ পরিসরে পালিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দিবসটি নানা আয়োজনের মাধ্যমে উদযাপন করা হবে।
১. শ্রদ্ধাঞ্জলি ও প্রভাতফেরি
- শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে।
- ভোরবেলা প্রভাতফেরিতে হাজারো মানুষ কালো ব্যাজ ধারণ করে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো” গান গাইবে।
২. সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
- কবিতা আবৃত্তি, নাটক ও সংগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার গুরুত্ব তুলে ধরা হবে।
- বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করবে।
- আন্তর্জাতিক উদ্যোগ
- বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশন ভাষা দিবস উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করবে।
- ইউনেস্কো ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ভাষা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করবে।
মাতৃভাষার গুরুত্ব
মাতৃভাষা শুধু কথা বলার মাধ্যম নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও পরিচয়ের অন্যতম প্রধান উপাদান। মাতৃভাষার মাধ্যমে মানুষ তার আবেগ, চিন্তা ও অভিব্যক্তি সহজভাবে প্রকাশ করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করলে তাদের শেখার দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া, ভাষাগত বৈচিত্র্য সংরক্ষণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য।
ভাষার সুরক্ষা ও ভবিষ্যৎ করণীয়
একুশে ফেব্রুয়ারির মূল বার্তা হলো ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা। আধুনিক বিশ্বে প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের করণীয়:
১. মাতৃভাষায় শিক্ষা ও গবেষণা: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাতৃভাষায় শিক্ষার গুরুত্ব বাড়াতে হবে এবং ভাষার উন্নয়নে গবেষণা করতে হবে।
2. সাহিত্য ও প্রকাশনা উৎসাহিত করা: বাংলা ভাষার বই, গবেষণা প্রবন্ধ ও সাহিত্যকর্ম প্রকাশের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানো দরকার।
3. ডিজিটাল মাধ্যমে ভাষা সংরক্ষণ: বাংলা ভাষাকে আরও বেশি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অন্তর্ভুক্ত করা এবং নতুন প্রজন্মের কাছে সহজলভ্য করা জরুরি।
একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু একটি দিন নয়, এটি আমাদের জাতীয় অহংকার ও আত্মপরিচয়ের প্রতীক। ২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের আবারও মনে করিয়ে দেবে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা ও ভাষাগত বৈচিত্র্য সংরক্ষণের গুরুত্ব। আসুন, আমরা সবাই মাতৃভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করি এবং একে আগামী প্রজন্মের জন্য সুরক্ষিত রাখার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করি।