আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে কিছু কথা

ভাষা মানুষের অস্তিত্বের মূল ভিত্তি। ভাষাই মানুষের পরিচয়, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং আবেগের প্রকাশ মাধ্যম। এই ভাষার জন্য অনেক জাতি সংগ্রাম করেছে, জীবন উৎসর্গ করেছে। এমনই এক অবিস্মরণীয় সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি হলো ২১শে ফেব্রুয়ারি, যা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
মাতৃভাষার গুরুত্ব
প্রত্যেক জাতির নিজস্ব একটি ভাষা থাকে, যা তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অন্যতম বাহক। মাতৃভাষা শিক্ষার মাধ্যমে একজন মানুষ তার চিন্তা-ভাবনা সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা যদি মাতৃভাষায় হয়, তাহলে তার শেখার দক্ষতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। মাতৃভাষার গুরুত্ব শুধু ব্যক্তিগত বা সামাজিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নয়; এটি জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম প্রধান উপাদান।
ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায়। তখন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা করে, যা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য ছিল এক বিশাল আঘাত। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রায় ৫৬ শতাংশের মাতৃভাষা ছিল বাংলা।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন যে, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” এই ঘোষণা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে। এরপর ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে, যা ধাপে ধাপে প্রবল হয়ে ওঠে।
একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে ঘটে এক রক্তাক্ত ঘটনা। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশ গুলি চালায়, যেখানে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ অনেকে শহীদ হন। এই দিনটিই পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় হয়ে ওঠে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি
বাংলা ভাষার জন্য এই আত্মত্যাগ শুধু বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টায় ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে প্রতিবছর সারা বিশ্বে এ দিনটি ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও সম্মানের প্রতীক হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
মাতৃভাষার সংরক্ষণ ও চ্যালেঞ্জ
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা হারিয়ে যাওয়ার মুখে পড়েছে। ইউনেস্কোর এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। তাই, ভাষার সংরক্ষণ ও প্রচার করা আজকের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশে বাংলা ভাষার প্রচলন থাকলেও, বর্তমানে ইংরেজি ও অন্যান্য বিদেশি ভাষার প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার ব্যবহার কমে যাচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। তাই মাতৃভাষার প্রচার ও সংরক্ষণে সরকার এবং জনগণকে একযোগে কাজ করতে হবে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কেবলমাত্র স্মরণ করার জন্য নয়, এটি আমাদের মাতৃভাষার প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ারও আহ্বান জানায়। ভাষার প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সংরক্ষণ আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাদের আত্মত্যাগের মর্যাদা রাখতে হলে আমাদের বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার ও চর্চা নিশ্চিত করতে হবে।